Press Release

গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারিক হয়রানি নিয়ে বিশ্বের শতাধিক নোবেল লরিয়েট ও অন্যান্য বিশ্ব নেতাদের প্রেরিত খোলা চিঠির প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গত ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ —এ  প্রচারিত বিবৃতি বিষয়ে গ্রামীণ টেলিকমের বক্তব্য।


Published Date: 2023-09-10


 

 

প্রেক্ষাপট:

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের দরিদ্র অসহায় মানুষ বিশেষত অতি দরিদ্র ও অসহায় নারীদের দারিদ্রমুক্তি ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে তাদেরকে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক কর্মসূচি চালু করেন যা ১৯৮৩ সালে একটি সংবিধিবদ্ধ কাঠামোর অধীনে একটি স্বতন্ত্র ব্যাংকের মর্যাদা লাভ করে। ক্ষুদ্রঋণ (দরিদ্র, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য জামানতবিহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থা) এবং দরিদ্র নারীদেরকে আয়সৃষ্টিমূলক কাজে নিয়োজিত করে উদ্যোক্তায় পরিণত করার মাধ্যমে গ্রামীণ দারিদ্র বিমোচন ও দরিদ্র নারীদের ক্ষমতায়নে গ্রামীণ ব্যাংকের অসাধারণ সাফল্যের কারণে বিশ্বব্যাপী এই কর্মসূচি প্রসার লাভ করে। তাঁর এই অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৬ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সৃষ্টি গ্রামীণ ব্যাংককে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পৃথিবীর শতাধিক দেশে এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, বলিভিয়া, কেনিয়া ও মরক্কোর মত অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশেও দারিদ্র দূরীকরণে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্রঋণ মডেল অনুসৃত হচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণ ছাড়াও প্রফেসর ইউনূস বেকার দরিদ্র তরুণদেরকে মূলধনী পুঁজি সরবরাহ করে তাদেরকে উদ্যোক্তায় পরিণত করতে “নবীন উদ্যোক্তা” কর্মসূচি চালু করেন যা দেশের লক্ষ লক্ষ বেকার তরুণকে অত্মনির্ভর করছে। এছাড়া প্রচলিত মুনাফা—কেন্দ্রিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা পৃথিবীতে নজিরবিহীন সম্পদ—কেন্দ্রীকরণ, ব্যাপক অসমতা, সম্পদের অপচয় এবং পরিবেশ বিপর্যয় সহ অসংখ্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি করছে তার বিপরীতে একটি লভ্যাংশবিহীন (যেখানে কোম্পানীর মুনাফা লভ্যাংশ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বন্টন না করে বরং সমাজকে অধিকতর সেবা প্রদানের লক্ষ্যে কোম্পানীতেই পুনঃবিনিয়োজিত হয়), আর্থিক ও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই, পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল এবং সমাজের জরুরী সমস্যাসমূহ সমাধানে মনোযোগী একটি বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে তাঁর “সামাজিক ব্যবসা” তত্ত্ব বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, তাইওয়ান, জাপান, তুরস্ক, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, পোলান্ড, ব্রাজিল, মেক্সিকো, কলম্বিয়া, কেনিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, জার্মানী, ইটালী, প্যালেস্টাইন সহ পৃথিবীর প্রায় ৪০টি দেশের শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়বস্তু হিসেবে পঠিত হচ্ছে। তাঁর সামাজিক ব্যবসা মডেলে দেশেই তিনি ৫০টির মত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন যেগুলি স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, টেলিযোগাযোগ, কৃষি, শিক্ষা, মৎস্য ও পশুপালন, সৌরশক্তি, বস্ত্র ইত্যাদি খাতে কাজ করছে। উদাহরণ হিসেবে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ কল্যাণ ও গ্রামীণ হেলথকেয়ার সার্ভিসেস লিঃ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১৫০টিরও বেশী স্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিচালনা করছে যারা গ্রামের লক্ষ লক্ষ মানুষকে স্বল্প খরচে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছে এবং গ্রামীণ ক্যালেডোনিয়ান কলেজ অব নার্সিং শত শত প্রশিক্ষিত নার্স সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্য খাতকে সমৃদ্ধ করছে। একইভাবে বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠায় নরওয়ের টেলিনরের অন্যতম অংশীদার গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণ ব্যাংকের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র ঋণগ্রহীতা নারীকে নিজ নিজ এলাকায় টেলিফোন সেবা বিক্রি করে আত্মনির্ভর হতেই কেবল সহায়তা করেনি, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিকে সেলুলার ফোন সেবার আওতায় নিয়ে এসে তাদেরকে বহির্বিশ্বের সাথে যুক্ত করেছে।

 

কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তর কর্তৃক গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বি,এল,এ (ফৌজদারী) মামলা নং— ২২৮/২০২১ এর বিবরণ:

 

গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানী আইনের ২৮ ধারায় সৃষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান (নট ফর প্রফিট কোম্পানী)। কোম্পানী আইন অনুযায়ী এর লভ্যাংশ বিতরণযোগ্য নয় বিধায় কর্মকর্তা—কর্মচারীদের মধ্যে নীট মুনাফার ৫% WPPF প্রদান করার কোন সুযোগ নেই। বিষয়টি অবহিত থাকার কারণে দীর্ঘ ১০ বৎসর গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক—কর্মচারীগণ চাকুরীতে থাকাবস্থায় এবং অবসরে যাবার পরও কখনো WPPF দাবী করেন নাই। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে WPPF সুবিধা আদায়ের জন্য গ্রামীণ টেলিকমের কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর সিভিল বিধানের অধীন ২১১ ধারায়  শ্রম আদালতে অনেকগুলি সিভিল বি.এল.এ (আই,আর) মামলা দায়ের করেন। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর বিধানগুলি সাধারণ ধরনের যেখানে ধরে নেয়া হয়েছে যে, কোম্পানীর শেয়ারহোল্ডারগণ কোম্পানীর কর্মকান্ড থেকে মুনাফা লাভ করবেন এবং মুনাফার একটি অংশ শ্রমিক—কর্মচারীদের সাথে ভাগাভাগি করে নেবেন। তবে এই বিধানগুলি গ্রামীণ টেলিকমের মত একটি অলাভজনক সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উক্ত অযৌক্তিক ও আইন বহির্ভূত দাবী—দাওয়া থেকে বিরত রাখার পরিবর্তে ইচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে গ্রামীণ টেলিকম সম্পর্কে ভুল ও মিথ্যা তথ্যের অবতারণা করে ডচচঋ সহ গ্রামীণ টেলিকমের অবৈতনিক চেয়ারম্যান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সহ চার জন পরিচালকের বিরুদ্ধে বি,এল,এ (ফৌজদারী) মামলা নং— ২২৮/২০২১ দায়ের করে।

 

এখানে উল্লেখ্য যে, গ্রামীণ টেলিকম তার পরিচালনা পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত তার নিজস্ব চাকরিবিধি মোতাবেক তার কর্মচারীদের সকল ধরনের সুযোগ—সুবিধা দিয়ে থাকে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কর্তৃক গত ০৯/৯/২০২১ তারিখে তৃতীয় শ্রম আদালতে যে ফৌজদারী মামলা দায়ের করা হয়েছে সেখানে গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে ৩টি বিধি ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে:

 

অভিযোগ নং ০১: চাকুরী স্থায়ীকরণ না করা।

ধারা ৪(৭)(৮): প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক/কর্মচারীদের শিক্ষানবীশকাল সমায়ান্তে আইনের বিধান অনুযায়ী স্থায়ীকরণ করা হয়নি।

 

এক্ষেত্রে গ্রামীণ টেলিকম যা করেছে:

গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তা—কর্মচারীদের নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী চুক্তি—ভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয়। কারণ গ্রামীণ টেলিকম যে সকল ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে সেগুলি চুক্তি—ভিত্তিক এবং নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে তা নবায়নের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। নোকিয়া কেয়ার, হুয়াওয়ে কেয়ার এবং পল্লীফোন কার্যক্রম ৩ বছরের চুক্তি অনুযায়ী পরিচালিত হয় এবং ৩ বছর পর আবার চুক্তি নবায়ন করে তা পরিচালনা করা হয়। যেহেতু গ্রামীণ টেলিকমের কার্যক্রম উপরেল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে চুক্তির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে, সেজন্য গ্রামীণ টেলিকমের সকল কর্মকর্তা—কর্মচারীকে চুক্তি—ভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবসায়িক চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির সাথে সাথে অনুরূপভাবে কর্মকর্তা—কর্মচারীদের চুক্তির মেয়াদও বৃদ্ধি করা হয়েছে। গ্রামীণ টেলিকমের সকল কর্মকর্তা—কর্মচারীকে স্থায়ী কর্মীর মতোই প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচ্যুইটি, অর্জিত ছুটি, অবসরকালীন ছুটিসহ সবই প্রদান করা হয়ে থাকে।

 

আমাদের মন্তব্য : ধারা ৪(৮)—এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, শিক্ষানবীশকাল শেষে বা তিন মাস মেয়াদ বৃদ্ধির পর কনফারমেশন লেটার দেওয়া না হইলেও উপ—ধারা (৭) এর বিধান অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট শ্রমিক স্থায়ী বলিয়া গণ্য হইবে। যেহেতু শ্রম আইনের মধ্যে উক্ত লংঘনের প্রতিকার দেয়া আছে, ফলে তা কোনভাবেই ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না, শ্রম আইন অনুযায়ী তা প্রশাসনিক ও সিভিল মোকদ্দমার বিষয়।

 

অভিযোগ নং ০২: বাৎসরিক ছুটি নগদায়ন না করা।

ধারা—১১৭ বিধি ১০৭ মোতাবেক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক/কর্মচারীদের আইনের বিধান অনুসারে মজুরীসহ বাৎসরিক ছুটি প্রদান, ছুটি নগদায়ন ও ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ প্রদান করা হয় না বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

  

এক্ষেত্রে গ্রামীণ টেলিকম যা করেছে:

1.       গ্রামীণ টেলিকমের অর্জিত ছুটি সংক্রান্ত নীতিমালা ২০০২ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে, যা ১লা জানুয়ারী ১৯৯৭ সাল থেকে কার্যকর করা হয়েছে। যদিও শ্রম আইন ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত।

2.      বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ ধারা ৩(১) অনুযায়ী “প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতিমালা থাকিতে পারে। তবে তা শ্রম আইনে উল্লেখিত সুবিধা হতে কম হতে পারবেনা।”

3.      গ্রামীণ টেলিকমের নীতিমালায় বছরে ৩০ দিন অর্জিত ছুটির বিধান রেখে ছুটির নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে, যেখানে শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতি ১৮ কর্ম দিবসের জন্য ১ দিন ছুটি। সেই হিসেবে গ্রামীণ টেলিকমের ক্ষেত্রে গড়ে বছরে সর্বোচ্চ ১৪ দিন অর্জিত ছুটি সাধারণত সকল কর্মী প্রাপ্য হন। অর্থাৎ গ্রামীণ টেলিকম শ্রম আইনের সুবিধার চেয়ে অধিক হারে অর্জিত ছুটি প্রদান করে থাকে।

4.      গ্রামীণ টেলিকমের অর্জিত ছুটি নগদায়নের ক্ষেত্রে একজন কর্মকর্তা/কর্মচারী প্রতি ৩ বছরে ৩০ দিনের ছুটি নগদায়ন করতে পারবে এবং ৬০ দিন ছুটি জমা রাখতে পারবে।

5.      ছুটি নগদায়নের ক্ষেত্রে শ্রম আইনে গ্রামীণ টেলিকমের ক্ষেত্রে কর্মকর্তা—কর্মচারীরা প্রতি বছরে ১৪ দিন পেয়ে থাকেন যার ৭ দিন নগদায়ন হবে এবং বাকী ৭ দিন জমা থাকবে। আর গ্রামীণ টেলিকমের প্রচলিত ছুটি নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি ৩ বছরে ৩০ দিন ছুটি নগদায়ন করে থাকে। অর্থাৎ বছরে গড়ে ১০ দিন নগদায়ন হচ্ছে। এই নগদায়নের ক্ষেত্রে শ্রম আইনের চেয়ে বেশি দেয়া হয়েছে।

 

আমাদের মন্তব্য: শ্রম আইনের ১১৭(৭) ধারায় উল্লেখ আছে যে, কোন শ্রমিক অর্জিত ছুটির জন্য দরখাস্ত করিলে যদি মালিক কোন কারণে উহা না— মঞ্জুর করেন তাহা হইলে উক্ত না— মঞ্জুরকৃত ছুটি সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের মূল অর্জিত ছুটির সাথে অতিরিক্ত পাওনা হিসাবে যুক্ত হবে। যেহেতু শ্রম আইনে এর প্রতিকারের বিধান আছে তাই তা কোনভাবেই ফৌজদারী অপরাধ নয়। শ্রম আইন অনুযায়ী তা প্রশাসনিক ও সিভিল মোকদ্দমার বিষয়।

 

উল্লেখ্য যে, গ্রামীণ টেলিকমে বাৎসরিক ছুটি নগদায়ন ১৯৯৭ সাল থেকে চালু করা আছে যা শ্রম আইনের চেয়ে অধিক। পরবর্তীতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নির্দেশে ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ তারিখের বোর্ড সভায় শ্রম আইন মোতাবেক প্রদান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা ১লা জানুয়ারী ২০২১ থেকে কার্যকর করা হয়েছে। বিষয়টি গত ২৯/০৮/২০২১ তারিখে পত্রের মাধ্যমে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে জানিয়ে দেয়া হয়, অথচ এ বিষয়ে তারা ০৯/৯/২০২১ তারিখে মামলা করেছে।

 

অভিযোগ নং ০৩ : অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল শ্রম আইনের ২৩৪ ধারা অনুযায়ী গঠন করা হয় নাই :

অভিযোগে বলা হয়েছে যে, ধারা ২৩৪ অনুযায়ী শ্রমিক অংশ গ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয় নাই এবং নীট লভ্যাংশের ৫% উক্ত দুটি তহবিল এবং শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন ২০০৬ অনুযায়ী গঠিত তহবিলে নির্দিষ্ট হারে প্রদান করা হয়নি।

 

এক্ষেত্রে গ্রামীণ টেলিকম যা করেছে : 

গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানী আইনের  ২৮ ধারায় সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান। এর লভ্যাংশ বিতরণযোগ্য নয় বিধায় নীট প্রফিটের ৫% WPPF প্রদান করার সুযোগ নেই। তথাপিও এ বিষয়ে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক—কর্মচারী ইউনিয়ন উক্ত অর্থ প্রাপ্তির জন্য আদালতে বিভিন্ন সময়ে শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করে। মামলা চলমান থাকায় WPPF (অংশ গ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল) গঠন করা হয়নি। এ বিষয়ে কলকারখানা অধিদপ্তরকে জানানো হয় যে, এ বিষয়ে মামলা চলমান রয়েছে। আদালত যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবেন আমরা সেভাবে ব্যবস্থা নেবো।

 

আইনের বিধান:

শ্রম আইনের ২৩৬ ধারায় জরিমানা, অর্থ আদায় ইত্যাদির প্রতিকারের বিধান দেয়া আছে যা নিম্নরূপ:

 

(১)       যে ক্ষেত্রে কোন কোম্পানী বা ট্রাষ্টিবোর্ড ধারা ২৩৪ এর বিধান সমূহ প্রতিপালন করিতে ব্যর্থ হয় সে ক্ষেত্রে সরকার আদেশ দ্বারা উক্ত আদেশে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে, সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী কর্ম সম্পাদনের নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবে।

(২)       যদি উল্লেখিত কার্য সম্পাদনে ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে অনধিক ০১ (এক) লক্ষ টাকা এবং অব্যাহত ব্যর্থতার ক্ষেত্রে, ব্যর্থতার প্রথম তারিখের পর হইতে প্রত্যেক দিনের জন্য আরও ০৫ (পাঁচ) হাজার টাকা করিয়া জরিমানা আরোপ করিয়া পরবর্তী ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে জরিমানার মোট অর্থ পরিশোধের জন্য নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবে।

তবে শর্ত থাকে যে কোন ব্যক্তি উল্লেখিত বিধান পুনরায় লঙ্ঘন করিলে বা প্রতিপালনে ব্যর্থ হইলে তাহার বিরুদ্ধে দ্বিগুণ জরিমানা আরোপিত হইবে।

(৩)      ধারা ২৩৪ এর অধীন প্রদেয় কোন অর্থ অপরিশোধিত থাকিলে এবং এই ধারার অধীন আরোপিত জরিমানা Public Demand Recovery Act, ১৯১৩ এর বিধান অনুযায়ী আদায়যোগ্য হইবে।

(৪)       সংক্ষুদ্ধ কোন ব্যক্তি উহা পুনঃবিবেচনার জন্য সরকারের নিকট আদেশের ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে দরখাস্ত পেশ করিতে পারিবেন এবং সরকার উহা প্রাপ্তির পর অনধিক ৪৫ (পঁয়তাল্লিশ) দিনের মধ্যে বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করত যথাযথ আদেশ প্রদান করিবে।

(৫)      উপ—ধারা (৪) এর অধীন সরকার কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ চূড়ান্ত বলিয়া গণ্য হইবে।

 

আমাদের মন্তব্য: শ্রম আইনের ২৩৪ ধারার বিধান প্রতিপালন লংঘিত হইলে ২৩৬ ধারায় অনেকগুলি প্রতিকারের বিধান রয়েছে।

 

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কর্তৃক ড. ইউনূস সহ ৪ জনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগের ধারা ৪(৭)(৮), ১১৭ এবং ২৩৪ সমূহ হচ্ছে প্রশাসনিক ধরনের এবং শ্রম আইনেই এর প্রতিকার রয়েছে। এঁরা সকলেই অ—নির্বাহী বোর্ড সদস্য এবং কোম্পানীর দায়িত্ব পালনে তাঁদের কোন মালিকানাজনিত স্বার্থ নেই। এরপরও তাঁদের বিরুদ্ধে অধিদপ্তর কর্তৃক ফৌজদারী মামলা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হয়রানিমূলক।

 

যে সকল ধারা ফৌজদারী অপরাধ হিসাবে গণ্য উহার বিশদ বর্ণনা বাংলাদেশ শ্রম আইনের উনবিংশ অধ্যায়ে অপরাধ, দন্ড এবং পদ্ধতি শিরোনামে উল্লেখ আছে। উক্ত উনবিংশ অধ্যায়ে এই মামলায় বর্ণিত ৪(৭)(৮), ১১৭ এবং ২৩৪ ধারা সমূহকে ফৌজদারী অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে উহা সন্নিবেশিত করা হয় নাই।

 

এছাড়া অত্র মামলার বাদী যিনি একজন লেবার ইন্সপেক্টর শ্রম আইনের বিধান অনুযায়ী বিবাদীদের বিরুদ্ধে তাঁর ফৌজদারী মামলা দায়ের করার আইনগত কোন ক্ষমতা নাই। ধারা ৩১৯ (৫) অনুযায়ী উক্ত মামলা দায়ের করার ক্ষমতা কেবলমাত্র মহাপরিদর্শক বা তাঁর অধীনস্থ কোন ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে শ্রম আইনের ৩১৩ (২) ধারায় আদালতের উপরও আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে যে, তিনি মহাপরিদর্শক অথবা তাঁর নিকট হতে ক্ষমতা প্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা ছাড়া কোন মামলা গ্রহণ করতে পারবেন না। মামলায় এই শর্তটিও পূরণ করা হয়নি। 

 

গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃক সমঝোতা চুক্তির অধীনে অর্থ প্রদান

২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে গ্রামীণ টেলিকমের মোট ১০৬ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ২১৩ ধারা মোতাবেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করেন। গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন (সিবিএ) শ্রম আদালতে শিল্প বিরোধ মোকদ্দমা (নং—১৬৬৬/২০১৯) দায়ের করে।

 

গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক—কর্মচারী ইউনিয়ন (সিবিএ) শ্রম আদালতে তাদের দায়েরকৃত শিল্পবিরোধ মামলা নং— ১৬৬৬/২০১৯ এর বিষয় গোপন করত ০৪/০৪/২০২২ ইং তারিখে হাইকোর্টের কোম্পানী কোর্টে Company Matters No. ২৭১ এর ২০২২ দায়ের করে গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানী অবলুপ্তির প্রার্থনা দায়ের করে এবং হাইকোর্টের কোম্পানী কোর্ট কর্তৃক মোকদ্দমাটি শুনানীর জন্য গৃহীত (Admitted) হবার আদেশ আদায় করতে সক্ষম হয়। এই প্রেক্ষিতে গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে আরো জটিল না করে শ্রমিক—কর্মচারী ও সিবিএ এর সাথে একটি সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে বিষয়টি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির চেষ্টা করে এবং এই উদ্দেশ্যে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে (Company Matter No. 271 এর অধীনে) একটি যৌথ দরখাস্ত দাখিল করলে গত ২৩/০৫/২০২২ইং তারিখে মাননীয় আদালত নিম্নলিখিত আদেশ জারী করেন:

“In view of the fact both the parties of the matter have amicable settled the dispute out of court, therefore, this court is of the view that there is no point of keeping this matter pending. As such, this court is inclined to dismiss the matter for non-prosecution.

 

Accordingly, the Company matter No. 271 of 2021 is dismissed on the ground of non-prosecution.

 

শ্রমিক—কর্মচারী ইউনিয়ন (সিবিএ) এর সাথে সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক গ্রামীণ টেলিকম শ্রম আইন ২০০৬ এর ২৩৪ ধারার বিধান অনুযায়ী ২০১০ সাল থেকে শুরু করে ২০২১—২০২২ অর্থ বছর পর্যন্ত Net Profit এর ৫% WPPF পাওনার ৯০% শ্রমিক—কর্মচারীদেরকে ব্যাংক একাউন্টের মাধমে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক—কর্মচারী ইউনিয়ন (সিবিএ) এর সাথে সমঝোতায় সম্পাদিত Settlement Agreement এর আওতায় ইতিমধ্যে প্রদান করা হয়েছে। মোট সুবিধাভোগী ১৬৪ জনের মধ্যে এ পর্যন্ত ১৫৬ জনকে তাঁদের প্রাপ্য অর্থ প্রদান করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, অবশিষ্ট ৮ জনের মধ্যে ৪ জন দেশের বাইরে এবং ৪ জন মারা যাওয়ার কারণে দেয়া হয়নি। তবে তাঁদের অংশ Settlement Account —এ রয়েছে, যা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রদান করা হবে। WPPF অর্থ পরিশোধের জন্য ৪৩৭,০১,১২,৬২১/— টাকা ব্যাংক হিসাবে প্রদান করা হয়েছে।

 

কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে আপত্তি উত্থাপন করা হয় যে, শ্রমিক—কর্মচারী ইউনিয়ন (সিবিএ) এর সাথে সমঝোতা Agreement সম্পন্ন করে তার আওতায় গ্রামীণ টেলিকম WPPF এর অর্থ শ্রমিক—কর্মচারীদের নিকট সরাসরি বিতরণ আইনসম্মত হয়নি এবং এই মর্মে গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করে। তাদের এই অভিযোগ পুরোপুরি মহামান্য হাইকোর্টি বিভাগ প্রদত্ত আদেশের পরিপন্থী যেখানে উভয়পক্ষ কর্তৃক সম্মত অর্থ পরিশোধের পদ্ধতিটি বিবেচনায় নিয়ে আদেশটি প্রদান করা হয়েছিল।

 

দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ—পরিচালক জনাব গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে গত ৩০ মে ২০২৩ ইং তারিখে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস সহ আরও সাত জন বোর্ড মেম্বারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দন্ড বিধি আইনের ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা এবং মানিলন্ডারিং আইন, ২০১২ এর ৪(২)(৩) ধারায় মামলা (নং—১২) দায়ের করেন। মামলার এজাহারে বলা হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ নাজমুল ইসলাম সহ গ্রামীণ টেলিকম বোর্ডের সদস্যদের উপস্থিতিতে ২০২২ সালের ৯ মে গ্রামীণ টেলিকমের ১০৮তম বোর্ড সভায় ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, গুলশান শাখায় একটি ব্যাংক একাউন্ট খোলার সিদ্ধান্ত হয়। তবে হিসাব খোলার এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের একদিন আগেই ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়। এছাড়া ২৭ এপ্রিল ২০২২ তারিখে সম্পাদিত Settlement Agreement এর মধ্যে ৯ মে তারিখের খোলা ব্যাংক একাউন্টটি দেখানো হয়েছে যা বাস্তবে অসম্ভব। এজাহারে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বোর্ড সদস্যদের সহায়তার গ্রামীণ টেলিকমের সিবিএ নেতা এবং এডভোকেট সহ সংশ্লিষ্টরা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়। 

 

সম্পাদিত Settlement Agreement এর অন্যতম শর্ত ছিল কর্মকর্তা—কর্মচারীরা গ্রামীণ টেলিকম থেকে সম্মিলিত ভাবে ৪,৩৭,০১,১২,৬২১/— টাকা পাবেন। পরবর্তীতে পুনরায় হিসাব করলে পূর্বের ভুল ধরা পড়ে যার সংশোধিত ও সঠিক হিসাব ৪,০৯,৬৯,২২,৭৮৯/— টাকা মর্মে সাব্যস্ত হয়। গ্রামীণ টেলিকম ও শ্রমিক ইউনিয়ন উক্ত হিসাব সঠিক মর্মে গ্রহণ করে। চুক্তির শর্তানুযায়ী উক্ত টাকা নির্ধারিত ব্যাংক হিসাবে হস্তান্তর করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন কোন ধরনের প্রমাণ ব্যতিরেকে উক্ত টাকা গ্রামীণ টেলিকমের বোর্ড সদস্যরা আত্মসাৎ এর মাধ্যমে অবৈধ ভাবে লাভবান হয়েছেন বলে অভিযোগ দায়ের করেন। এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।

 

সমঝোতা চুক্তির” দুটি বিষয়কে উপজীব্য করে দুদক উক্ত অভিযোগ দায়ের করেছেন। প্রথমত, গ্রামীণ টেলিকম থেকে ১,৬৩,৯১,৩৮৯/— টাকা অতিরিক্ত প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী সমঝোতার জন্য নির্ধারিত মোট টাকা ব্যাংক একাউন্টে হস্তান্তরের পর পুনঃ হিসাবের মাধ্যমে মোট প্রদেয় টাকার পরিমাণ কমে যায়। অর্থ গ্রহণের পূর্বে সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী তাঁদের প্রাপ্য টাকা থেকে ৬% তাঁদের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের পেশাগত ফি ও বিবিধ খরচ বাবদ ইউনিয়নকে প্রদান করতে লিখিত অঙ্গীকার নামা প্রদান করেন। শ্রমিক—কর্মচারী ইউনিয়ন মোট প্রদেয় ৪৩৭,০১,১২,৬২১/— টাকার স্থলে ৪০৯,৬৯,২২,৭৮৯/— টাকা মেনে নিলেও তাঁদের আইনজীবী ফি ও বিবিধ খরচ বাবদ পূর্বের হিসাবকৃত ৪৩৭,০১,১২,৬২১/— টাকার উপর ৬% দাবী করেন এবং ৪০৯,৬৯,২২,৭৮৯/— টাকার উপর ৬% নিতে অস্বীকৃতি জানান। উক্ত সমস্যার উদ্ভব হলে গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষ নতুন করে আবার বিবাদে জড়িয়ে পড়ে সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তিকৃত বিষয়টি বিতর্কের মাধ্যমে জিইয়ে রাখা কিংবা উক্ত বিষয়ে আবার আদালতের দ্বারস্থ হয়ে মূল্যবান সময় ও অর্থের অপচয় করা থেকে নিষ্কৃতির জন্য এবং উক্ত টাকা পূর্বের নির্ধারিত মোট প্রদেয় টাকার মধ্যে থাকায় উহা প্রদানে সম্মত হয়। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণে অর্থাৎ ব্যাংকের মাধ্যমে ও যাবতীয় বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে উক্ত টাকা হস্তান্তর করা হয়। এজাহারে বর্ণিত আছে ইউনিয়নের নেতারা উক্ত পরিমাণ টাকার কিয়দংশ আইনজীবীদের প্রেরণ করে বাকি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। যদি এটি সত্য হয় তবে তা দুঃখজনক। কিন্তু গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান বা বোর্ড মেম্বারদের উক্ত লেনদেনে দূরতম কোন সম্পর্কও ছিল না, কেননা উক্ত পরিমাণ টাকা সেটেলমেন্ট একাউন্ট থেকে সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের লিখিত অঙ্গীকারনামা অনুযায়ী তাঁদের প্রাপ্য অর্থ থেকে ইউনিয়ন এর একাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়েছিল এবং ইউনিয়নের একাউন্টে গ্রামীণ টেলিকম বা এর বোর্ড মেম্বারদের কোনরূপ কর্তৃত্ব নেই।

 

দুদক কর্তৃক উত্থাপিত অভিযোগের দ্বিতীয় বিষয়টি হলো গ্রামীণ টেলিকম এর সাথে শ্রমিক—কর্মচারী ইউনিয়নের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে ২৭ এপ্রিল ২০২২ তারিখে। অন্যদিকে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে দাবীকৃত অংশগ্রহণ তহবিলের টাকা প্রদানের জন্য ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়েছে  ৮ মে, ২০২২ তারিখে। কিন্তু উক্ত একাউন্ট নম্বরটি সম্পাদিত সমঝোতা চুক্তিতে উল্লেখ আছে। সুতরাং সমঝোতা চুক্তিপত্রটি ভূয়া ও জাল—জালিয়াতির মাধ্যমে উক্ত টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

 

প্রকৃত সত্য হলো, সমঝোতা চুক্তি ২৭ এপ্রিল ২০২২ ইং তারিখে কম্পিউটার কম্পোজের মাধ্যমে তৈরী ও উভয়পক্ষের স্বাক্ষরিত হলেও ব্যাংক একাউন্ট নম্বর লিপিবদ্ধ করার জন্য জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে ব্যাংক একাউন্ট খোলার পর উভয়পক্ষের সম্মতিতে তা হাতে লিখে সন্নিবেশ করা হয়। উক্ত ব্যাংক হিসাবটিতে গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক—কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে সিগনেটারী হিসেবে রাখা হয়েছে। উক্ত বিষয়ে ৯ মে ২০২২ তারিখে বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের পরই ব্যাংকে টাকা হস্তান্তর করা হয়। উভয় পক্ষের সম্মতিতে হাতে লিখে ব্যাংক হিসাব নম্বর সমঝোতা চুক্তিপত্রে সন্নিবেশ করার কারণে তা আইনত জাল বা ভূয়া বলে বিবেচিত হয়না। অন্যদিকে সমঝোতা চুক্তিটি চলমান কোম্পানী ম্যাটারের মামলায় জমা প্রদান করা হলে মহামান্য হাইকোর্ট বিনা প্রশ্নে সমঝোতা চুক্তিটি আমলে নিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করেছেন।

 

আবার দায়েরকৃত এজাহারে বিভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণায় ‘ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস এর নির্দেশে’ কথাটি যুক্ত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্বেষ থেকে এটি করা হয়েছে কেননা এই ধরনের কথার স্বপক্ষে কোনরকম বাস্তব প্রমাণ নেই। গ্রামীণ টেলিকমের যাবতীয় বিষয়াদি বোর্ড মিটিংয়ে আলোচনার মাধ্যমে বোর্ড সদস্যদের সর্বসম্মত  সিদ্ধান্ত হিসেবেই গৃহীত হয়।

প্রফেসর ইউনূসের কর ”ফাঁকি”(?):

 

প্রফেসর ইউনূসের আয়কর নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে যে আলাপ—আলোচনা চলছে তার পুরোটাই প্রফেসর ইউনূসের অর্জিত টাকা। তাঁর উপার্জনের সূত্র প্রধানত তাঁর বক্তৃতার উপর প্রাপ্ত ফি, বই বিক্রিলব্ধ টাকা এবং পুরস্কারের টাকা। এর প্রায় পুরো টাকাটাই বিদেশে অর্জিত টাকা। এই টাকা বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে আনীত। কর বিভাগ তা অবহিত আছে। কারণ সব টাকার হিসাব তাঁর আয়কর রিটার্ণে উল্লেখ থাকে।

 

তিনি জীবনে কোনো সম্পদের মালিক হতে চাননি। তিনি মালিকানামুক্ত থাকতে চান। কোথাও তাঁর মালিকানায় কোন সম্পদ নেই (বাড়ি, গাড়ি, জমি, শেয়ার ইত্যাদি)। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর উপার্জনের টাকা দিয়ে তিনি দু’টি ট্রাস্ট গঠন করবেন। তিনি তাই করলেন।

 

একটি ট্রাস্ট করলেন “প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ট্রাস্ট” এবং অল্প কিছু টাকা দিয়ে (মোট টাকার ৬%) উত্তরসূরীদের কল্যাণের জন্য করলেন “ইউনূস ফ্যামিলি ট্রাস্ট”। ফ্যামিলি ট্রাস্টের মূল দলিলে এইরূপ বিধান রেখে দিলেন যে, তাঁর পরবর্তী এক প্রজন্ম পরে এই ট্রাস্টের অবশিষ্ট টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল ট্রাস্টে ফিরে যাবে।

 

তিনি এটা করলেন যাতে তাঁর বর্তমানে এবং অবর্তমানে টাকাটা ট্রাস্টিদের তত্ত্বাবধানে নিরাপদে থাকে এবং তাঁরা ট্রাস্ট দুটির লক্ষ্য বাস্তবায়নে তৎপর থাকেন।

 

তাঁর নিজের টাকা নিজের কাছে রেখে দিলে তাঁকে কম ট্যাক্স দিতে হতো। কারণ ব্যক্তিগত করের হার প্রতিষ্ঠানিক করের হারের চেয়ে কম। দানকরের প্রসঙ্গটি তুললেন তাঁর আইনজীবি।

 

আইন পরামর্শক বললেন, ট্রাস্ট গঠনের কারণে তাঁকে দানকর দিতে হবে না। কারণ বড় ট্রাস্টটি জনকল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠিত। ফ্যামিলি ট্রাস্টের ব্যাপারে তিনি পরামর্শ দিলেন যে, এরকম ক্ষেত্রে (অর্থাৎ প্রফেসর  ইউনূসের অবর্তমানে তাঁর সম্পদের কী হবে সে চিন্তায় যদি তিনি কোন ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন তবে সেক্ষেত্রে) তাঁকে কোনো কর দিতে হবেনা। কারণ এটা হবে তাঁর অর্জিত টাকার একটি সুব্যবস্থা করে যাওয়া। তাঁর পরামর্শের ভিত্তিতে  টাকা স্থানান্তর করার সময় প্রফেসর ইউনূস কোন কর দেননি। কিন্তু তিনি আয়কর রিটার্ন দাখিল করার পর কর বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানালেন যে, এক্ষেত্রে তাঁকে কর দিতে হবে। রিটার্ণের যেখানে তিনি দানের তথ্যটি উল্লেখ করেছিলেন সংশ্লিষ্ট কর কর্মকর্তা তার উপর দানকর ধার্য করে দিলেন। তিনি টাকার অংকটা রিটার্ণস—এ উল্লেখ করায় কর কর্মকর্তা তা দেখে কর আরোপ করেছেন।

 

আইন পরামর্শকের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রফেসর ইউনূস এ ব্যাপারে আদালতের সিদ্ধান্ত চাইলেন। আদালত কর দেবার পক্ষে মত দিয়েছেন।

 

এই হলো মোট ঘটনা। এখানে তাঁর কর ”ফাঁকি” দেবার কোনো প্রশ্নই নেই। কর দিতে হবে কিনা এব্যাপারে তাঁর পক্ষ থেকেই আদালতের সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া হয়েছিল। আদালতে সরকার যায়নি, প্রফেসর ইউনূস গিয়েছেন। কর বিভাগ কোনো পর্যায়ে বলেনি যে প্রফেসর ইউনূস কর ফাঁকি দিয়েছেন। এখানে কর ফাঁকি দেবার কোন প্রশ্ন উঠেনি। প্রশ্ন ছিল আইনের প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে। প্রফেসর ইউনূস এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত চাইলে উচ্চ আদালত কর দেবার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে উক্ত কর পরিশোধ করে দেন। করের আইন যদি এক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য না হতো তাহলে প্রফেসর ইউনূস সে—টাকাটা জনহিতকর কাজে ব্যবহারের সুযোগ পেতেন। কর নিয়ে চিন্তা ভাবনার পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এটাই, এবং তা কোনোভাবেই ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে নয়।

 

গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি’র পদ:

প্রফেসর ইউনূস কখনোই গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ ধরে রাখার জন্য উৎসুক ছিলেন না। সরকারি ব্যাংকের মত এই ব্যাংকের এমডি’র জন্য কোন বয়সসীমা ছিল না। তিনি যতবারই এই পদ ছেড়ে দিতে চাইছিলেন, প্রতিবারই পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা তাঁকে ব্যাংক ছেড়ে চলে না যেতে অনুরোধ করছিলেন। ১৯৯০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার ৬০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয় এবং ঋণগ্রহীতাদের শেয়ার ৪০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ শতাংশ করা হয়। সংশোধিত অধ্যাদেশ অনুযায়ী ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন সাপেক্ষে পরিচালনা পরিষদের উপর ন্যস্ত করা হয়। ব্যাংকের সকল নিয়মনীতি তৈরীর ক্ষমতা পরিচালনা পরিষদকে দেয়া হয়। তেরো সদস্য বিশিষ্ট পরিচালনা পরিষদে চেয়ারম্যানসহ তিন জন সদস্য নিয়োগ দেয়া ছাড়া আর কোনো ক্ষমতাই সরকারের কাছে রাখা হয়নি। সরকারী চাকুরী বিধি অনুসরণ করার কোনো বাধ্যবাধকতা গ্রামীণ ব্যাংকে রাখা হয়নি। অন্যান্য ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের মতো ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিয়োগ দেবার ক্ষমতা রাখা হয়েছিল বোর্ডের কাছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ বা তার শর্তাবলী ধার্য করার ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের কাছে রাখা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক অবসরে যাবার বয়সের প্রশ্ন তুলে প্রফেসর ইউনূসকে পদত্যাগ করতে নির্দেশ দেয় ২০১১ সালে। প্রফেসর ইউনূসকে এমডি’র পদ থেকে যখন সরানো হয়, তখন গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের মালিকানা ছিল ৯৭% আর সরকারের ছিল ৩%। এ সময়ে প্রফেসর ইউনূস হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন। হাইকোর্ট শুনানির জন্য তাঁর রীট আবেদন এই মর্মে প্রত্যাখান করেন যে, এই পিটিশন দাখিলযোগ্য নয়, অর্থাৎ  আইনের ভাষায় এটা দাখিল করার ‘লোকাস স্ট্যান্ডি’ তাঁর নেই। এরপর তিনি আপীল বিভাগের নিকট আপীল করেন এবং আপীল বিভাগও একই মর্মে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। প্রফেসর ইউনূস আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে অবিলম্বে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরে দাঁড়ান।

 

উপসংহার:

উপরোক্ত পর্যালোচনার আলোকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, কোনরূপ তথ্য—প্রমাণ ব্যতিরেকে মামলাটি গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও বোর্ড সদস্যদের দীর্ঘদিনের অর্জিত সুনামে কালিমা লেপনের উদ্দেশ্যেই দায়ের করা হয়েছে যা একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে গ্রামীণ টেলিকম এর চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বোর্ড মেম্বারদের ব্যতিব্যস্ত রাখার মধ্য দিয়ে তাঁদের দ্বারা পরিচালিত জনকল্যাণমূলক কাজে বিঘ্ন সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপপ্রয়াস মাত্র।


Unable to display PDF file. Download instead.